আধ্যাত্মিক দর্পণ ::::: মে – ১২

আমল কবূল হওয়ার

পূর্ব শর্ত ইখলাস

মাওলানা আবু রায়হান মোহাম্মদ শুয়াইব

হযরত মু‘আয (রা.)কে প্রিয় নবীজী (সা.) যখন ইয়ামানের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণ করছিলেন, তখন মু‘আয (রা.) বলেছিলেন, “আমাকে কিছু ওসীয়ত করুন ইয়া রাসূলাল্লাহ। প্রিয় নবীজী বললেন, “দ্বীনের কাজে ইখলাসের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখবে।”

ইখলাসের সাথে প্রতিটি কাজের মূল্য জড়িত। ইখলাস ব্যতীত কোন আমল আল্লাহ তা‘আলার নিকট গ্রহণীয় হয় না। ইখলাস হলো বিশুদ্ধ নিয়ত ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাজ করা। ত্রিশতম পারায় সূরাহ বাইয়্যিনার ৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে।”

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা দ্বীনকে খাঁটি করো। তাহলে তোমার সামান্য আমলই যথেষ্ট হবে।”

যার কাজকর্ম ইখলাসের সাথে হবে, তার ঈমান পরিপূর্ণতা পাবে। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞাসা করল – ঈমান কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন – ইখলাস। ইখলাসের কারণেই ঈমানের মজবুতী আসে। ইখলাসপূর্ণ আমলই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন – “আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক সূরত ও সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমালের প্রতি দৃষ্টি করেন।” (মিশকাত শরীফ)।

আমলের মধ্যে ইখলাস না থাকলে, তাতে শিরক হয়। এভাবে আমল দ্বারা ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে বলেন – আমি তোমাদের জন্য যে সব বিষয়ের আশংকা করি, তন্মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে গোপন শিরক। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন – গোপন শিরক কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন – “রিয়া (লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা) হচ্ছে গোপন শিরক।” (ইবনে কাছীর)

আল্লাহর নিকট লোক দেখানো ইবাদতের কোনই মূল্য নেই। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহ বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি আমলের মধ্যে কাউকে আমার সাথে শরীক করে, তবে উক্ত ব্যক্তিকে তার শিরকের উপর সোপর্দ করি।” অন্য বর্ণনাতে আছে “আমি তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাই।” (মিশকাত শরীফ)

অপর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন – “কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে এক ঘোষণাকারী উচ্চস্বরে ঘোষণা করবেন, যে ব্যক্তি কোন আমলের মাঝে অন্য কাউকে শরীক করেছে সে যেন তার প্রতিদান তার থেকেই আদায় করে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যে কোন প্রকার অংশ স্থাপন থেকে মুক্ত।” (মিশকাত শরীফ)

পবিত্র কুরআনের সূরাহ আলে ইমরানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আল্লাহ তার সাথে অংশী স্থাপনকে ক্ষমা করবেন না।”

ইখলাস না থাকলে আমলের ছাওয়াব বরবাদ হয়ে যায়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, “ক্বিয়ামতের দিবসে সর্বপ্রথম যাদের ফয়সালা শোনানো হবে, তন্মধ্যে একজন শহীদ হবে। তাকে ডেকে আল্লাহ পাক স্বীয় নিয়ামতসমূহ স্মরণ করাবেন। সেই ব্যক্তি তা চিনবে এবং স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, ঐ সব নিয়ামতের প্রতিদানে তুমি কী কাজ করেছো? সে উত্তরে বলবে, হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য জিহাদ করেছি এবং শহীদ হয়েছি। তাকে বলা হবে – তুমি মিথ্যা বলছো। লোকে তোমাকে বীর পুরুষ বলবে – এ জন্য এটা করেছো। আর তাতো বলা হয়েছেই। অতঃপর তাকে শাস্তির আদেশ শুনানো হবে এবং অধঃমুখী করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

দ্বিতীয়ত ঐ আলেমের বিচার হবে – যিনি ইলম শিখেছেন এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছেন। তাকে ডেকে তার ওপর প্রদত্ত নিয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। তিনি তা স্বীকার করবেন। তারপর আল্লাহপাক তাকে জিজ্ঞাসা করবেন – ঐ সব নিয়ামতের পরিবর্তে তুমি কী আমল করেছো? তিনি বলবেন – হে মা‘বুদ! আপনার সন্তুষ্টির জন্য ইলম শিখেছি এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। আপনার রেজামন্দির আশায় কালামে পাক পড়েছি। তখন তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি তো এজন্য ইলম শিখেছিলে যে, লোকেরা তোমাকে আলেম বলবে। তোমার সে উদ্দেশ্য তো পূর্ণ হয়েছে, লোকেরা তোমাকে আলেম বলেছে। অতঃপর তাকে শাস্তির আদেশ শুনানো হবে এবং অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তৃতীয়ত ধনাঢ্য ব্যক্তির হিসাব হবে – যাকে আল্লাহপাক প্রচুর পরিমাণ ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে হাজির করে প্রদত্ত নিয়ামতের স্বীকারোক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, এগুলোর প্রতিদানে কী আমল করেছো? সে বলবে – হে পরওয়ারদেগার! আপনার রাস্তায় আমি আমার ধন-সম্পদ দান করেছি। তখন বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি তো ঐসব এজন্য করেছো যে, লোকেরা তোমাকে বড় দাতা বলবে। আর তা তো বলা হয়েছে। অতঃপর শাস্তির নির্দেশ শোনানো হবে এবং টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিশকাত শরীফ)

তাই সকল আমলদারের কর্তব্য – যাবতীয় আমল একমাত্র মহান আল্লাহকে রাজী-খুশী করার জন্য করা, দুনিয়ার কোন স্বার্থে বা লোক দেখানোর জন্য না করা। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, কুরবানী, দান-খাইরাত, ইলম অর্জন প্রভৃতি সকল কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করতে হবে। এর নামই ইখলাস। তাহলেই সে সব আমল মহান আল্লাহ কবুল করবেন এবং পরকালে এসবের উত্তম বিনিময় লাভ করবেন।

 

Related posts

Leave a Comment